Last speech

জাকারিয়া চৌধুরীর ইতিকথা

                                                      —– জাহাঙ্গীর চৌধুরী

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মিছিল করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হোন। ছাত্রাবস্থায় লন্ডনে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার পরিকল্পনায় ‘পূর্বসূরী’ নামে গোপন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৩ সনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যখন লন্ডনে এক সংক্ষিপ্ত সফরে আসেন তখন জাকারিয়া চৌধুরী তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য স্বাধীনতার কথাটা বঙ্গবন্ধুর কাছে উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু তার সাথে এক মত পোষণ করেন। সেই অবধি বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ প্রতিবাদে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশন জবরদখলের নেতৃত্ব দেন ও প্রখ্যাত আইনজীবি Barrister Sir Thomas Williams-Q. C.-কে মামলা পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। আইয়ুব শাহী পতনের পর ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পুনরায় লন্ডন যান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ওনাকে ব্যক্তিগত দূত হিসাবে লন্ডনে অবস্থান নিতে বলেন। তখন এয়ারপোর্টের কর্তৃত্ব পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিয়ে নেয় এবং আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিরাপত্তা আরোপ করে। যেহেতু তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিক হিসাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে চিহ্নিত ছিলেন সেহেতু এয়ারপোর্ট দিয়ে লন্ডন যাওয়া সমীচীন মনে করেননি। তবে ২৫শে মার্চের পৈচাশিক ঘটনার পর তিনি আত্নগোপনে থেকে ৩রা এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের আশায় ঢাকা ছেড়ে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে যান। অনেক বিদ্রোহী বাঙ্গালী সেনারা তখন মেজর খালেদ মোশাররফের (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ঐ চা-বাগানে অবস্থানরত ছিল। বিদ্রোহী বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করে ওনাকে লন্ডনে চলে গিয়ে ‘অর্থ’ ও ‘অস্ত্র’ সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পন করেন। যদিও ওনার মন তখন মোটেই রণাঙ্গন ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। লন্ডনে তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত দূত (Personal Emissary) পরিচয়েই সাংগঠনিক কার্য্যক্রম শুরু করেন। সে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন মেজর নূরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মঈনুল হোসেন চৌধুরী (পরবর্তীতে দুজনই মেজর জেনারেল হন)।

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য তখন বিলেতে মরহুম আজিজুল হক ভূঁইয়াকে আহবায়ক ও মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে যে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় তিনি সেই সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কার্য্যক্রম শুরু করেন এবং ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য হেমব্রোজ ব্যাংকে (Hambros Bank) একাউন্ট খোলেন। পরবর্তীতে সেই একাউন্ট ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যাংকে (National West Minister Bank) স্থানান্তর করা হয়।

১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চে সেই নৃশংস পাকিস্তানী সামরিক হামলার প্রতিবাদে লন্ডনসহ বিলেতের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী দেশবাসী কর্তৃক প্রতিবাদের ঝড় উঠে, গঠিত হয় Action Committee। লক্ষ লক্ষ পাউন্ডের চাঁদা জমা হতে থাকে Action Committee’র ফান্ডে। সংগৃহীত এই ফান্ডের টাকায় পৃথিবীব্যাপী প্রচার কার্য্য চালানো হয়, যুদ্ধের জন্য কেনা হয় রসদ ও সাজ-সরঞ্জাম এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের পর উদ্বৃত্ত টাকা দান করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে। সব Action Committee’র সমম্বয় সাধনের জন্য গঠিত হয় “Steering Committee of the Action Committees for the Liberation of Bangladesh in U.K.” যা 11No.Goring Street, London E-1 এ অবস্থিত ছিল। কূটনৈতিক লবিং এর জন্য ‘বাংলাদেশ মিশন’ নাম দিয়ে ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন, লন্ডন ডব্লিউ-২ -(24 Pembridge Garden, London W-2)-তে অফিস স্থাপন করা হয়। মিশনের প্রধান হিসাবে মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দায়িত্বরত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের ৯ মাস লন্ডন ছিল প্রতিবাদ ও প্রচারে মুখরিত। বিলেতের দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর তৎপরতা ও ত্যাগের কারনেই আর্ন্তজাতিক প্রচার মাধ্যম আমাদের প্রতি বরাবর সহানুভূতিশীল ও সোচ্চার ছিল যা যুদ্ধ জয়ের জন্য অপরিহার্য্য।

১৯৭২ সালে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন।

১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা পদে যোগ দেন। তখন শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় ভিন্ন দুইটি মন্ত্রণালয় ছিল। তিনি তখন ৩টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেনঃ (১) শ্রম মন্ত্রণালয় (Ministry of Labour), (২) জনশক্তি মন্ত্রণালয় (Ministry of Man Power) ও (৩) সমাজকল্যান মন্ত্রণালয় (Ministry of Social Welfare)।

জনাব জাকারিয়া চৌধুরীর নিজ দেশের বাড়ী হাওড় এলাকায়। অতএব নেত্রকোনা, ব্রাক্ষনবাড়ীয়ার কিছু অংশ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ জুড়ে যে বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা রয়েছে সেই সকল এলাকার আর্থ-সামাজিক সমস্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এক পর্যায়ে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হাওড় উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে সেখানকার সম্পদ এবং সম্ভাবনাকে সু-সংগঠিত করে এলাকার উন্নয়ন সু-সম্পন্ন করার পরামর্শ দেন। উল্লেখ থাকে যে, হাওড় এলাকার বড় সমস্যা হলঃ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতের অভাব, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব ইত্যাদি বিষয়ে হাওড় উন্নয়ন বোর্ড-কে পরিকল্পনা প্রণয়ন করার দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে বিচক্ষণ শ্রদ্ধেয় জনাব জাকারিয়া চৌধুরীর পরামর্শে ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হাওড় উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যাহার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড (Bangladesh Haor & Wetland Development Board)।   

মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে দিল্লীতে UNCATD (United Nations Commerce and Trade Development) এর Conference এ যাওয়ার দুইদিন আগে তার সাথে দেখা করার জন্য জনাব জাকারিয়া চৌধুরীকে তার (জিয়াউর রহমান) বাসায় দেখা করতে বলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট এর বাসায় গেলে প্রেসিডেন্ট বলেন “আপনি নিশ্চয় জানেন ২দিন পরেই দিল্লী যাচ্ছি। সেখানে আমার সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা সাক্ষাত হবে। আপনি তো জানেন মিসেস গান্ধী আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। এই অবস্থায় আমি কি বলে কথাবার্তা শুরু করতে পারি।” তিনি (জাকারিয়া চৌধুরী) ঘন্টাখানেক ধরে জিয়াউর রহমানকে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেন – “যদিও আমরা এখন বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত, আমাদের উপমহাদেশ ঐতিহাসিকভাবে এক বৃহত্তর ধারায় প্রবাহিত। তাছাড়া আজকের পৃথিবীতে আঞ্চলিকভাবে সংগঠিত হয়ে একটা সমন্নিত নীতির ও পরিকল্পনার মাধ্যমে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারি”। জনাব জাকারিয়া চৌধুরী তখন প্রস্তাব দেন- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান নিয়ে একটি রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক ফোরাম গঠন করার কথা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে উপস্থাপন করতে পারেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় সার্ক (S.A.A.R.C.)। তখন ওনার (জাকারিয়া চৌধুরীর) প্রস্তাবে মালদ্বীপ ছিল না। যাহা পরে সংযুক্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট তখন ওনার আইডিয়াটি অতি আগ্রহের সাথে গ্রহন করে লিখিতভাবে পরের দিন দুপুর ১২টার মধ্যে বঙ্গভবনে পৌছে দিতে বলেন। জিয়াউর রহমান এই ব্যাপারে বঙ্গভবনের ষ্টাফের সহায়তা নিতে বলেন। জনাব জাকারিয়া চৌধুরী তখন রাত্র ১০টায় বাসায় ফিরে তাহার এক বন্ধু এনায়েত রাব্বিকে (মুক্তিযোদ্বা) এক জরুরী কাজে তাহার বাসায় আসতে বলেন। জাকারিয়া চৌধুরী তখন চিন্তা করলেন যে, বঙ্গভবনের ষ্টেনোকে dictation দিতে গেলে ভুলভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী হবে যা পরে বার বার করে শোধরাতে হতে পারে। তার চেয়ে বন্ধু এনায়েত ইংরেজী ভাষায় যার ভাল দখল, তার long hand এ dictation দিলে কাজটা সহজ হয়। বন্ধু এনায়েত বাসায় এলে তখন তাহারা দু’জনে রাত জেগে একটা ব্রীফ (brief) তৈরী করেন। এনায়েত এই ব্রীফ (brief) নিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে বঙ্গভবনে গিয়ে তা টাইপ করার আয়োজন করে এবং তা edit করে finalise করেন। ইহার কপি বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে (Foreign Ministry) সংরক্ষিত আছে।

প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার দিন কয়েক পরে জনাব জাকারিয়া চৌধুরীকে তার বাসায় সাক্ষাতের জন্য অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ জাকারিয়া চৌধুরীর স্ত্রী শামীম সিকদারকে ফোন করে এ আহ্বান জানান। সেখানে নানা আলাপের মধ্যে প্রশাসনিক কি ধরনের সংস্কার দেশের জন্য প্রয়োজন মনে করেন বলে জনাব জাকারিয়া চৌধুরীর কাছে মতামত জানতে চান। জাকারিয়া চৌধুরী প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উপর গুরুত্ব দিয়ে থানা পর্যায়ে পূর্ণ প্রশাসনিক অব কাঠামো স্থাপনের জন্য পরামর্শ দেন। তাতে করে বিচ্ছিন্ন থাকা গ্রামের লোক প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে এবং গ্রামে উন্নয়নের দ্বার উম্মোচিত হবে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কাগজ কলম নিয়ে নোট নিতে গেলে জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে হলিডে পত্রিকাতে ১৯৭৯ সালে নভেম্বর মাসের কোন এক সংখ্যায় লেখা আমার নিবন্ধ “A blue print for good Government” আমি আপনাকে পৌছে দিব’। তিনি সেই অনুযায়ী তা সি.এম.এল.এ. (Chief Marshal Law Administrator {C.M.L.A.}) দপ্তরে পৌছে দেন এবং কপি তার (জাকারিয়া চৌধুরী) বন্ধু তখনকার মন্ত্রী মরহুম ওবায়দুল্লা খান ও আবুল মাল আবদুল মুহিতের নিকট পৌছে দেন। যা পরে উপজেলা নামে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোঃ এরশাদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আন্দোলনের মুখোমুখি হোন। কারণ পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বিমুখ ছিলেন।

ইহার ফলশ্রুতিতে (১) জনগণের দ্বোরগোড়ায় প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা পৌছে যাওয়ায় জনগণ তা থেকে উপকৃত হচ্ছে।
(২) শহর ও গ্রামের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ কিছুটা হলেও হয়েছে।

বর্তমানে তিনি লেখালেখিতে বিশেষভাবে সক্রিয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by Software Shell